Javed Iqbal |
জাভেদ ইকবালের বিভীষিকা: এক ভয়ংকর গল্প
১৯৯৮ সালের এক হিমশীতল রাত। লাহোর শহর মৃদু বাতাসে ঢেকে আছে, রাস্তাগুলো নির্জন, আর চারিদিকে রহস্যময় এক স্তব্ধতা। কিন্তু এই অন্ধকারের গভীরে এক অদ্ভুত ছায়া কাজ করে চলেছে, যার কোনো দয়া বা মায়া নেই। সে ছায়া হলো জাভেদ ইকবাল, এক নারকীয় খুনী, যে শিশুগুলোর জীবনকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
জাভেদ ইকবালের শৈশব ছিল অস্বাভাবিক। তার মা তাকে তেমন ভালোবাসতেন না, আর বাবা ছিলেন শাসক প্রকৃতির। ছোটবেলা থেকেই জাভেদ সমাজের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ছিল। যখন সে বড় হতে লাগল, তার মানসিক অবস্থা ক্রমশ অস্বাভাবিক ও হিংস্র হয়ে ওঠে। সে শুরুতে ছোটখাটো চুরি আর সহিংসতায় জড়িত ছিল, কিন্তু কেউ কখনো ভাবেনি, এই মানুষ একদিন হয়ে উঠবে পাকিস্তানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার।
জাভেদ নিজের বাড়িটাকে মৃত্যুর আস্তানা বানায়। তার কৌশল ছিল ভয়াবহ—কেউ বুঝতেও পারবে না, কীভাবে সে শিশুগুলোকে নিজের ফাঁদে ফেলত। ছোট বাচ্চাদের সে খাবার, খেলনা বা টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসত। তার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, সেই ঘরটা হয়ে উঠত এক মৃত্যুপুরী। আর সেই মৃত্যুর সাক্ষী ছিল শুধু সেই চার দেয়াল।
একদিন, ১২ বছরের একটি বাচ্চা, আসিফ, শহরের রাস্তায় খেলছিল। জাভেদ তার পাশ দিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়, তার চোখে অদ্ভুত এক মায়াবী চাহনি। আসিফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, জাভেদ তাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আসিফ জানত না, তার জন্য অপেক্ষা করছে এক অন্ধকার, যা কোনোদিন তার স্বপ্নেও আসেনি।
বাড়িতে পৌঁছে জাভেদ আসিফকে তার গোপন কক্ষে নিয়ে যায়। সেই কক্ষটি ছিল অদ্ভুতভাবে সাজানো, দেয়ালে অদ্ভুত সব চিত্র, কিছু রক্তের দাগ আর অন্ধকারের এক ভীতিকর গন্ধ। আসিফ ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু তার আর পালানোর সুযোগ ছিল না। জাভেদ তার স্বাভাবিক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এরপর যা ঘটল, তা বর্ণনা করা যায় না। নির্দয় জাভেদ একের পর এক শিশুকে এমনভাবেই হত্যা করত, যেন তাদের জীবন কোনো মূল্য নেই। প্রতিটি হত্যার পর তার মন শান্ত হত, কিন্তু সেই শান্তি ক্ষণস্থায়ী ছিল। যেন তার মনের ভেতরে এক অনন্ত খিদে কাজ করছিল, যা কিছুতেই থামছিল না।
বহুদিন পর্যন্ত কেউ জানত না, শহরের এই অদ্ভুত অদৃশ্য আতঙ্কের মূল কে। শহরে হারিয়ে যাওয়া শিশুগুলোর জন্য মা-বাবারা কাঁদত, কিন্তু পুলিশ কোনো কুলকিনারা করতে পারছিল না।
একদিন, সব বদলে গেল। জাভেদ নিজের অপরাধের ভারে ভেঙে পড়ল এবং লাহোর পুলিশকে চিঠি লিখল। চিঠিতে সে বলল, “আমি ১০০টি শিশুকে হত্যা করেছি। আমি আর পারছি না। আমাকে গ্রেপ্তার করো।” পুলিশ চিঠিটি পেয়ে স্তম্ভিত হয়। তারা অবিলম্বে জাভেদের বাড়িতে অভিযান চালায়।
তাদের চোখের সামনে ছিল এক ভয়ংকর দৃশ্য। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বাচ্চাদের পোশাক, দেয়ালে লেগে ছিল রক্তের দাগ। তারা সেখান থেকে উদ্ধার করল অ্যাসিডের পাত্র, যেখানে জাভেদ তার শিকারদের দেহ গলিয়ে ফেলত।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর জাভেদ তার প্রতিটি হত্যার বিবরণ দেয়। সে কোনো অনুশোচনা দেখায়নি। তার মুখে ছিল শুধু এক নির্মম চাহনি, যেন তার পাপের কোনো ওজন নেই। আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, এবং ঘোষণা করে, তাকে সেই একই পদ্ধতিতে হত্যা করা হবে, যেভাবে সে বাচ্চাদের হত্যা করেছিল।
কিন্তু মৃত্যুর আগেই একদিন জাভেদকে কারাগারে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কেউ জানত না, সে আত্মহত্যা করেছিল, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তার মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হলো এক কালো অধ্যায়। কিন্তু লাহোর শহরের বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায় সেই বিভীষিকার গল্প, যেখানকার অন্ধকার গলিতে হয়তো কোনো এক জাভেদ ইকবালের মতো আরেকজন খুনী আজও হেঁটে চলেছে, অপেক্ষা করছে নতুন শিকারের।
সেই অন্ধকারের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয় শিশুদের কান্না, যাদের আত্মা আজও মুক্তি পায়নি।